Friday, March 30, 2012

২০১২ সাল এবং হলিউডের নতুন নতুন ফিল্ম নির্মাণের প্রস্তুতি


পৃথিবীর সকল সমাজেই কাল বা সময় থেকে অর্জন করা এবং ভবিষ্যতে কীভাবে আরো বেশি অর্জন করা যায় সে নিয়ে চেষ্টা প্রচেষ্টার অন্ত নেই। বিশেষ করে সমাজের বিজ্ঞজন যারা তাঁরা এ সম্পর্কে নিজেদের চিন্তাভাবনাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অনেকে আবার কল্পনার পাখায় ভর করে কিংবা অলিক চিন্তাভাবনার আলোকেও নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে থাকেন। যাঁরা এ ধরনের চিন্তাভাবনা করেন তাঁদের মধ্যে শিল্পীসমাজ যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছেন সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণও। সমাজের এই বিশেষ শ্রেণীর ব্যক্তিত্বগণ নিজেদের চিন্তাভাবনা আর কল্পনার ওপর ভর করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেন। এ ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- ভবিষ্যৎ নিয়ে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা চেষ্টা প্রচেষ্টার মূলে বৈজ্ঞানিক কোনো চিন্তা কাজ করে নি। তারা যদি জ্ঞান ও বিজ্ঞান ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দিতেন তাহলে সেইসব ভবিষ্যদ্বাণী এতোটা ঝাপসা বা অন্ধকারাচ্ছন্ন হতো না। পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে মার্কিন মুলুকেই বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে বলে অলিক কল্পনা প্রসূত ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

বিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পশ্চিমাদের যেসব ভবিষ্যদ্বাণী সেগুলোর উৎস হলো "মায়া"দের ঐতিহাসিক ক্যালেন্ডার এবং নস্ট্রাডামাসের রহস্যময় রচনা। গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বের ভবিষ্যৎ চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে এগুলোই ছিল তাদের উৎস। নস্ট্রাডামাস ছিল ফরাশি একজন ইহুদি চিকিৎসাবিদ। তাঁর জীবনকাল হলো খ্রিষ্টিয় ষোলো শতক। যাদুবিদ্যায় তিনি বেশ দক্ষ ছিলেন। তিনি তাঁর রচনায় বিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বহু লেখালেখি করেন এবং সর্বশেষ ত্রাণকর্তা সম্পর্কেও বহু বর্ণনা দিয়েছেন। সেইসাথে অনাগত শতাব্দিগেুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। অবশ্য তার ভবিষ্যদ্বাণীতে বহু ভুল ত্রুটি রয়েছে, যদিও অনেকেই সেগুলোকে দূর করার জন্যে বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন।


যারা খ্রিস্টজন্মের হাজার হাজার বছর আগেকার পৃথিবীর অধিবাসী ছিল তারা বিশ্বাস করতো যে পৃথিবী ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বরে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই দিনে পাঁচ হাজার এক শ পচিঁশ বছর পর মায়ানদের ক্যালেন্ডারের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগ দেখা দেবে। কিন্তু বিশ্বের সমাপ্তির সাথে এই ক্যালেন্ডারের কী সম্পর্ক রয়েছে? মায়ানরা বলছে, পঞ্জিকার দিন গণনা যেদিন শেষ হবে সেদিন পৃথিবীতে অবশ্যই দুর্ঘটনা ঘটবে। তাদের পঞ্জিকা অনুযায়ী পৃথিবীর ম্যাগনেটিক অঙ্গনে জটিলতা দেখা দেবে, সৌরজগতের সকল গ্রহ নক্ষত্র সূর্যের পেছনে এসে যাবে, সানস্টর্ম বা সূর্যঝড় দেখা দেবে এবং পৃথিবীর সাথে ধাক্কা লাগবে অচেনা এক গ্রহের ইত্যাদি। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এখন মেঘ, বাতাস, কুয়াশা, সূর্য এবং আকাশ ২০১২ সালে বিশ্ব ধ্বংসের কাজে ব্যস্ত। আবার পৃথিবীতে এমন অনেক লোকও রয়েছেন যারা এইসব ভবিষ্যদ্বাণী, ক্যালেন্ডার, বিশ্বের ঘটনা-দুর্ঘটনা এগুলোকে পাশে ঢেলে রেখেই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মত দিচ্ছেন। কিন্তু এসব কি আসলে সত্যিই?

তো মায়ানদের ক্যালেন্ডারের কথাই বলুন আর অ-মায়াদের ভবিষ্যদ্বাণীর কথাই বলুন যে প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলো- সত্যিই কি পৃথিবীর আয়ু ফুরিয়ে এসেছে? পৃথিবীর বাসিন্দারা কি তাহলে আর বছর খানেকের মধ্যে এই পৃথিবীকে কিংবা নিজেদের জীবনকে "বিদায়" বলবে? চলুন! এইসব কল্পিত চিন্তার রহস্যময়তা থেকে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে জ্ঞানী গুণী মনীষীদের বক্তব্যের প্রতি একটু মনোযোগ দেই। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ভূ-তত্ত্ববিদ এডাম মালুফ বলেছেনঃ "ম্যাগনেটিক স্টোনগুলোর সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো প্রমাণ করছে যে অতীতেও পৃথিবীতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর সময় ধরে ঘটেছে এবং এতোটাই ধীরে ধীরে ঘটেছে যে মানুষ ঐ পরিবর্তন টেরই পায় নি। এখনো যদি এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে তাহলে অতীতের মতোই ঘটবে।"

পৃথিবীর সাথে অন্য একটি গ্রহের ধাক্কা লাগার ব্যাপারে মার্কিন নক্ষত্রবিদ ডেভিড মরিসন বলেছেনঃ "এই যে গ্রহটির কথা বলা হচ্ছে আসলে এরকম কোনো গ্রহেরই অস্তিত্ব নেই। যদি অস্তিত্ব থাকতোই, তাহলে আমরা অবশ্যই খালি চোখে হোক কিংবা যন্ত্রের সাহায্যে হোক তাকে দেখতে পেতাম। এ ধরনের আইডিয়ার উৎস হলো মিথ্যা গুজব। ২০০৩ সালে একজন মহিলা ঐসব গুজব ছড়িয়ে বলেছিল যে ২০১২ সালে বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে।" মায়া সভ্যতার গবেষকগণও সম্প্রতি বলেছেন বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে মায়ানদের পূর্বাভাসের কোনো সত্যতা নেই। মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এরিক ভ্লাস্কোন্স বলেছেনঃ মায়ান ক্যালেন্ডারে এইসব ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো অস্তিত্বই নেই, এগুলো একেবারেই ভুল এবং গুজব। ক্যালেন্ডারে রয়েছে ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর হলো কালচক্রের পরিবর্তনের দিন। অর্থাৎ এইদিন থেকে পরবর্তী যুগের সূচনা হবে। এখানে বিশ্ব ধ্বংসের কোনো ব্যাপার নেই।

এইসব মনীষী কিংবা গবেষকের বক্তব্য থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে অস্পষ্ট কোনো বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা ঠিক হবে না। যদিও অনেকেই আছেন যারা চাইবেন নিজেদের অলিক কল্পনার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে। এই শ্রেণীর জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ স্থানটি হলো হলিউড। মার্কিন এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ২০১২ সালে বিশ্ব ধ্বংসের পক্ষে অসংখ্য ফিল্ম তৈরি হয়েছে এবং সেগুলো বিশ্বব্যাপী প্রদর্শিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দর্শকগণ ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এইসব ফিল্মে বিচিত্র টেকনিক প্রয়োগ করে কিয়ামতের মতো কল্পিত দৃশ্য তৈরি করে প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগের মাধ্যমে পৃথিবীশুদ্ধ সকল মানুষকে একসাথে মৃত্যুবরণ করানো হয়েছে। এ ধরনের ফিল্ম তৈরির পেছনে নির্মাতাদের আর্থিক স্বার্থ যেমন রয়েছে তেমনি রাজনীতিবিদদেরও স্বার্থ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞমহলের ধারণা। কেননা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত চলচ্চিত্র মার্কেটের আয় থেকে মার্কিন রাজনীতিকগণও মুনাফা অর্জন করে থাকেন।

তাছাড়া এ ধরনের ফিল্ম সহজ সরল মানুষের মনের ওপরে এক ধরনের ভীতিকর ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরিমাঝে জানা গেছে যে, ২০১২ সালে বিশ্ব ধ্বংসের দিন ঘনিয়ে আসায়, ভয়ে অনেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এমনকি অনেকে আত্মহত্যাও করেছেন। দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে ২০১২ সালকে সামনে রেখে এ নিয়ে অপপ্রচারণার মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও রাজনীতি অঙ্গনের কুশীলবরা নতুন নতুন ফিল্ম নির্মাণ করে যাচ্ছেন। #

No comments:

Post a Comment