Saturday, January 14, 2012

স্ট্রবেরীর চাষ



from কৃষি তথ্য বিভাগ
স্ট্রবেরী চাষের আবহাওয়াঃ স্ট্রবেরী শীতের দেশের ফল। ভালো মান ও উচ্চফলনের জন্য দিনের বেলায় ২০ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতের বেলায় ১২ থেকে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দরকার হয়। শীতকালে বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকার তাপমাত্রা এ রকমই। এ ধরনের তাপমাত্রায় রাবি-৩ জাতের স্ট্রবেরী বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা যায়।

জমি নির্বাচনঃ স্ট্রবেরী চাষের শুরুতেই যে কাজটি করতে হবে তা হলো উপযুক্ত জমি নির্বাচন। সব সময় পর্যাপ্ত রোদ থাকে এবং পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা আছে এমন জমি বেছে নিতে হবে।


মাটির ধরনঃ যেসব মাটির পিএইচ ৬ থেকে ৭ এমন যেকোনো ধরনের মাটিতেই স্ট্রবেরীর চাষ করা যাবে। পিএইচ মান কম বা বেশি হলে স্ট্রবেরী চাষ ব্যাহত হয়। কাজেই যে জমিতে স্ট্রবেরী চাষ করার কথা ভাবছেন সেই জমির মাটির পিএইচ মান কত তা অবশ্যই পরীক্ষা করে জেনে নিতে হবে। একই সাথে মাটিতে কোন খাদ্য উপাদান কী পরিমাণে প্রয়োগ করতে হবে তাও মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নিতে হবে। এতে এক দিকে যেমন সারের অপচয় কমানো যাবে তেমনি চাষের খরচও কমিয়ে আনা যাবে। মাটি পরীক্ষার জন্য স্থানীয় কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, যেকোনো মাটিতেই স্ট্রবেরী চাষ করা যায় তবে বেলে-দোআঁশ মাটি সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত।

যে ধরনের জমি স্ট্রবেরী চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত নয়ঃ যেসব জমিতে আগে বেগুন, টমেটো, আলু বা অন্যান্য বেগুনজাতীয় ফসলের চাষ হয়েছে এমন জমি স্ট্রবেরী চাষের জন্য নির্বাচন করা ভালো নয়। কারণ এসব ফসল ভারটিসিলিয়াম উইল্ট নামের একধরনের ছত্রাকঘটিত রোগের জীবাণু বহন করে। কাজেই এ ধরনের জমিতে স্ট্রবেরী চাষ করলে এই জীবাণু স্ট্রবেরীগাছে সংক্রামিত হওয়ার সুযোগ থাকে।

জমি শোধনঃ বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকায় কোনো না কোনো ফসলের চাষ হয়। ফলে চাষকৃত জমিতে নানা ধরনের জীবাণু থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ জন্য স্ট্রবেরী চাষের জন্য বাছাই করা জমিটি অবশ্যই শোধন করে নিতে হবে। মাটি শোধনের জন্য শতাংশপ্রতি ৪০ থেকে ৬০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার অথবা ২ শতাংশ ফর্মালিন দ্রবণ ব্যবহার করা যেতে পারে। ফরমালিন ব্যবহার করলে জমি কালো পলিথিন দিয়ে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা ঢেকে রাখতে হবে।

জমি তৈরিঃ নির্বাচিত জমি ৫ থেকে ৬টি চাষ দিয়ে ভালোভাবে তৈরি করে নিতে হবে। এটা করতে হবে চারা লাগানোর এক মাস আগে।

কিভাবে চাষ করবেনঃ স্ট্রবেরীর চারা রোপণ করা যায় তিনটি পদ্ধতিতে। এগুলো হলো ম্যাটেড সারি পদ্ধতি, প্লাস্টিকলচার বা বেড পদ্ধতি এবং রিবোন সারি পদ্ধতি। বেড পদ্ধতিতে চাষ করাই ভালো। কারণ বেডে জন্মানো স্ট্রবেরীগাছে আগাম ফুল আসে, সহজে সেচ দেয়া যায় এবং ফল সংগ্রহে সুবিধা হয়।

বেড তৈরিঃ প্রতিটি বেডের আকার হবে লম্বায় ১৫ ফুট ও চওড়ায় ৩ ফুট। বেডের উচ্চতা হবে ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি। এক বেড থেকে আরেক বেডের দূরত্ব হবে ৩০ ইঞ্চি বা আড়াই ফুট। বেড তৈরির পর প্রতি বেডে ৩ থেকে ৪ ঝুড়ি বা ৪৫ থেকে ৫০ কেজি পচা গোবর সার বা কম্পোস্ট সার মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রতি বেডে ৭৫০ গ্রাম মিশ্রসার(৬ শতাংশ নাইট্রোজেন, ৮ শতাংশ ফসফেট ও ৪ শতাংশ পটাশ) ছড়িয়ে দিয়ে মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে এবং সমপরিমাণ সার বেডের মাঝ বরাবর ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি গভীর সোজা লাইনে প্রয়োগ করে মাটি দিয়ে লাইন ভরে দিতে হবে।


চারা রোপণঃ প্রতি বেডে দুই সারিতে চারা রোপণ করতে হবে। এক সারি থেকে আরেক সারির দূরত্ব হবে ২ ফুট। এক চারা থেকে আরেক চারার দূরত্ব হবে ১ ফুট। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে চারা রোপণ না করে মেঘলা দিনে সকাল বা বিকেলে চারা রোপণ করা ভালো। চারা লাগানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে কাণ্ডের গোড়া যেন মাটির ওপর থাকে। কোদাল বা ক্ষুন্তি দিয়ে ‘ভি’ আকৃতির গর্ত করে চারা বসিয়ে শিকড় মাটিতে ভালোভাবে ঢেকে হাত দিয়ে চাপ দিতে হবে। চারা মাটির ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি গভীরে রোপণ করতে হবে, যাতে মাটি থেকে গাছ প্রয়োজনীয় পানি গ্রহণ করতে পারে। চারা যদি পলিথিন ব্যাগে না থাকে তাহলে চারার শিকড় পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে। চারা যদি মাটির খুব কম গভীরে রোপণ করা হয় তাহলে প্রয়োজনীয় পানি না পেয়ে শিকড় শুকিয়ে গাছ মারা যেতে পারে।


চারা রোপণের সময়ঃ অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়।

চারার সংখ্যাঃ এক বিঘা জমিতে চারা লাগে প্রায় ৫ হাজার।

সেচঃ চারা রোপণের পরই বেড পানি সেচের মাধ্যমে হালকা করে ভিজিয়ে দিতে হবে। মালচিং দেয়া থাকলে সপ্তাহে এক দিন পানি সেচ দিলেই যথেষ্ট।

মালচিং: চারা রোপণের পর যাতে আগাছা বাড়তে না পারে, মাটির তাপমাত্রা ঠাণ্ডা থাকে এবং ফলকে মাটির সংস্পর্শ থেকে রক্ষা করা যায় সে জন্য মালচিং করা দরকার। মালচিং হিসেবে কালো পলিথিন ব্যবহার করা ভালো। এ ক্ষেত্রে চারা রোপণের আগেই মালচিং হিসেবে বেডের মাপ অনুযায়ী কালো পলিথিনে চারা রোপণের ছিদ্র করে বেডের ওপর বিছিয়ে দিতে হবে। এর আগে অবশ্য প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার করে নিতে হবে।

সারের ব্যবহারঃ মাটির পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে জমিতে সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। স্ট্রবেরী চাষ শুরুর কয়েক মাস আগে মাটি পরীক্ষা করে নিতে হবে। নাইট্রোজেন সারের উৎস হিসেবে ইউরিয়া ব্যবহার না করে অ্যামোনিয়াম সালফেট অথবা ডাইঅ্যামোনিয়াম ফসফেট ব্যবহার করা ভালো।

এক বিঘা জমিতে স্ট্রবেরী চাষের খরচঃ চারা কিনে স্ট্রবেরী চাষ করলে প্রতিটি চারা ২০ টাকা দাম হিসেবে ৫ হাজার চারার দাম পড়বে ১ লাখ টাকা। সার, জমি চাষ, সেচ, মালচিং, নেট দেয়া ইত্যাদি বাবদ ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক বিঘা জমিতে স্ট্রবেরী চাষ করতে খরচ পড়ে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। নিজেরা চারা তৈরি করে চাষ করলে খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। স্ট্রবেরী চারা উৎপাদন করা খুব সহজ। প্রথম বার চারা কিনে চাষ করলেও পরের বছর নিজের চারা নিজেই উৎপাদন করে নেয়া যায়।

আয়ের হিসাবঃ এ বছর চাষি ভাইয়েরা মাঠ থেকে পাইকারি ৫০০ টাকা কেজি দরে স্ট্রবেরী বিক্রি করছেন। ঢাকার মার্কেটে যা প্রায় ১০০০ টাকা কেজি দরে কিনছেন ক্রেতারা। গড়পরতা এক বিঘা জমিতে প্রায় ১৫০০ কেজি ফল পাওয়া যায়, যার বাজার মূল্য প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা।

No comments:

Post a Comment